কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে মিললো ৭০ মৃত কাছিম
- কক্সবাজার প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ১১:২০ এম, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত তিন দিনে ৭০টি কাছিম মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি)। এসব কাছিম মূলত জলপাই রঙের বা অলিভ রিডলি প্রজাতির। গত ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত টেকনাফ থেকে হিমছড়ি সৈকত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব মৃত কাছিম উদ্ধার করা হয়।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া।
তিনি জানান, গত শনিবার থেকে সোমবার সকাল ১১টা পর্যন্ত টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়ার রূপপতি এলাকা পর্যন্ত ১২টি কাছিমের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন রোববার রূপপতি থেকে সোনারপাড়া পর্যন্ত ৫০টি এবং প্যাঁচার দ্বীপ থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত আটটি মৃত কাছিমের দেহ উদ্ধার হয়।
তিনি আরও জানান, ধারণা করা হচ্ছে এই কাছিমগুলো গত দুই মাসের মধ্যে মারা গেছে। গত বেশ কিছু দিন ধরে সমুদ্র সৈকতে কাছিমের অনেকগুলো কঙ্কাল পাওয়া যায়।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল ভূঁইয়া উল্লেখ করেন, গত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন মৌসুম থাকে। এ সময় মা কাছিমেরা ডিম দিতে উপকূলে আসে। তবে মাঝে মাঝে জেলেদের জালে আটকা পড়ে বা বড় নৌযানের ধাক্কায় কাছিম মারা যায়। তবে মৃত কাছিমগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার জন্য তদন্ত চলছে।
উদ্ধারকৃত সবগুলো কাছিম অলিভ রিডলি প্রজাতির। এগুলোর মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী কাছিমও রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ১/২ দিন, কিছু সংখ্যক ৭ দিন এবং আর কিছু ১০/১৫ দিন বা তারও আগে মৃত্যু হয়েছে। কী কারণে প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছে তা নিশ্চিত করতে না পারলেও স্থানীয়দের তথ্যের বরাতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, ‘নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন মৌসুম। এ সময় কাছিম উপকূলে ডিম দিতে আসে। জেলেদের জালে আটকা পড়ে, সমুদ্রে চলাচলকারী বড় নৌযানের ধাক্কায় কিংবা উপকূলে ডিম পাড়তে এসে কুকুরের আক্রমণে এসব কাছিমের মৃত্যু হতে পারে।’
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সোনাদিয়া, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতে অন্তত ২৯টি মৃত কাছিম পাওয়া গিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ৩টি মৃত ডলফিন, ১টি মৃত পরপইসও ভেসে এসেছিল।
প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) বলছে, সামুদ্রিক মা কাছিম এখন মহাবিপদে রয়েছে। ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে ২০০৩ সালে সংস্থাটির এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কাছিম ডিম দিতে আসত। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কাছিমের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ পয়েন্ট ছিল।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন জানান, প্রতি বছর প্রজনন মৌসুমে সৈকতের আশেপাশে মৃত কাছিম পাওয়া যাচ্ছে। এসব কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্নও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো ছুরি বা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এসব প্রাণী হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেয়। আবার জোয়ারের পানিতে কাছিমগুলো উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলেছে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেওয়ার স্থানটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি। সেটি না করলে কাছিম রক্ষা করা যাবে না।
নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) উপ প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানান, ‘মা কাছিম ডিম দেওয়ার সময় সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু, যা এপ্রিল-মে পর্যন্ত চলে। তারা রাতের বেলায় নির্জন উপকূলে এসে গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। সাধারণত একটি মা কাছিম ৩০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিম দেওয়া শেষ করে তা মাটি, বালি বা অন্য কোনো জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর মা কাছিম ফিরে যায় সাগরে। ৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এরপর বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বের হয়ে সাগরে চলে যায়।’
শফিকুর রহমান আরও বলেন, ১০ বছর আগে ৫২ পয়েন্টে মা কাছিম ডিম দিতে এলেও বর্তমানে তা কমে ৩৪ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে শুরু করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় এসব কাছিম ডিম দিত। কিন্তু সমুদ্রপাড়ে ডিম দিতে এসে পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখন যেন আর নেই। ডিম দিতে এসে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মা কাছিম।