হাসিনা-কামালের বিচার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ: এইচআরডব্লিউ
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০১:৪২ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এই বিচারের প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এইচআরডব্লিউ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দুজন আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে এবং তারা নিজের পছন্দের আইনজীবী দ্বারা প্রতিনিধিত্ব পাননি, যা “গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ” সৃষ্টি করেছে। মামলার তৃতীয় আসামি, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়ার পর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
সংস্থাটি জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে, যেখানে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হন। নিহতদের অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান। দীর্ঘ সময়ের দমনমূলক শাসনের কারণে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ এখনও রয়ে গেছে। তবে এইচআরডব্লিউ বলেছে, “বিচার অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে হওয়া উচিত।”
মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিক্ষোভকারীদের ওপর সংগঠিত আক্রমণ, নিরাপত্তা বাহিনী ও দলীয় সমর্থকদের মাধ্যমে ব্যাপক দমন-পীড়নের নির্দেশ, ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে বা শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়া। প্রসিকিউশন মোট ৫৪ জন সাক্ষী হাজির করে, যাদের অর্ধেক বিশেষজ্ঞ এবং বাকিরা ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবার। প্রমাণ হিসেবে শেখ হাসিনার কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিং উপস্থাপন করা হয়, যেখানে তাকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায়।
রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী সাক্ষীদের জেরা করলেও অভিযোগ খণ্ডনে কোনো সাক্ষী হাজির করেননি। সংস্থাটি জানিয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, সাক্ষী জিজ্ঞাসাবাদের অধিকার এবং নিজের পছন্দের আইনজীবী পাওয়ার অধিকারএসবই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের অপরিহার্য অংশ, যা এই মামলায় রক্ষা করা হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের ফলে বিচার নিয়ে উদ্বেগ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারকেরা উল্লেখ করেছেন, রোম স্ট্যাটিউটের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ বিচার প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য আদালতের সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রায়ে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীর ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ উল্লেখ করলেও তিনি নিজের ‘নেতৃত্বের দায়’ স্বীকার করেছেন।
এইচআরডব্লিউ আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, হাসিনা সরকারের সময়ে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচার জরুরি, তবে তা অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হওয়া উচিত।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনুস দায়িত্ব নেন। তার সরকার নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও কমান্ড রেসপনসিবিলিটির সংজ্ঞা রোম স্ট্যাটিউটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে। গুমকে স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। তবে ২০২৫ সালের সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। রায়ে যদিও আওয়ামী লীগ ভাঙার নির্দেশ নেই, তবে হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা আরও তিনটি মামলার আসামি, যার মধ্যে দুটি গুম এবং একটি ২০১৩ সালের গণহত্যা সংক্রান্ত।
এইচআরডব্লিউ উল্লেখ করেছে, সংবিধানের ৪৭(৩) ও ৪৭এ ধারা আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের আইনি সুরক্ষা, ন্যায়বিচার ও প্রতিকার চাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সংস্থাটি সবাইকে সমান সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে এবং মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে তা বিলোপের দিকে অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দিয়েছে।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর এবং বাংলাদেশ সরকার তিন বছরের সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে মানবাধিকার সহায়তা বৃদ্ধির জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। এইচআরডব্লিউ বলেছে, “আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা জরুরি।”
রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানকে প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, “প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে ভারতকে অবশ্যই ন্যায়সংগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে; এমন কোনো দেশে কাউকে পাঠানো উচিত নয়, যেখানে মৃত্যুদণ্ড বা অন্যায্য বিচারের ঝুঁকি রয়েছে।”
এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “হাসিনা সরকারের আমলে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণের অধিকার রাখেন, তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা মানে অভিযুক্তদের অধিকারও সুরক্ষিত করা; এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ একটি জরুরি পদক্ষেপ।”