ড্রামে খণ্ডিত ২৬ টুকরা মরদেহ, সন্দেহের তীর বন্ধুর দিকে
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ১১:৩৯ এম, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহের সামনে প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে এক যুবকের খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, দু-এক দিন আগে ওই যুবককে হত্যার পর মরদেহ টুকরো করে ড্রামে ভরে সেখানে ফেলে রাখা হয়। গলা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের সব অঙ্গ আলাদা করা ছিল।
এই হত্যা নিয়ে ইতিমধ্যে নিহতের বন্ধু জরেজের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তার মা এছরা খাতুন।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সন্ধ্যার দিকে হাইকোর্টসংলগ্ন ফুটপাতে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ড্রামে প্রথমে নজর পড়ে পথচারীদের। পরে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে ড্রামের ভেতর থেকে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে। শুরুতে পরিচয় শনাক্ত করা না গেলেও পরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হয়।
নিহত আশরাফুল হক (৩৫) রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের আব্দুর রশীদের ছেলে। তিনি পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, আদাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করতেন। আশরাফুলের স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবা-মা রয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের বরাতে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাইকোর্টের সামনে রাস্তার পাশে নীল রঙের দুটি ড্রাম পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন থানায় খবর দেন। পরে ড্রাম খুলে দেখা যায়, একটি ড্রামে ছিল চাল, আরেকটিতে কালো পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় হাত, পা, মাথাসহ ২৬ টুকরো করা মরদেহ। মরদেহ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। পুলিশের ধারণা, দুই-এক দিন আগে তাকে হত্যা করে ড্রামে ভরা হয়। নিহতের মুখে দাড়ি ছিল এবং গলা থেকে পা পর্যন্ত পুরো দেহই খণ্ডিত করা হয়।
নিহতের মা এছরা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করে বলেন, “মোর ব্যাটাক জরেজ খায়া ফেলাইলো। মোর ব্যাটাক অয় নিয়ে গেছে। টাকা আনার জন্য জরেজ মোর ব্যাটাক নিয়ে গেইছে।”
স্থানীয়দের ভাষ্য, শৈশবের বন্ধু জরেজের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করতেন আশরাফুল। তবে তিন-চার বছর আগে জরেজ মালয়েশিয়ায় চলে যান। প্রায় এক মাস আগে তিনি দেশে ফিরে এসে এবার জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি বন্ধু আশরাফুলের কাছে টাকা ধার চেয়েছিলেন। আশরাফুলও তাকে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেন। এর মধ্যে গত শনিবার আশরাফুলের বাবা আব্দুর রশীদ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে রংপুরের প্রাইম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে বাবার সঙ্গে দেখা করে বন্ধু জরেজকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন আশরাফুল।
হত্যার শিকার আশরাফুলের বাবা আব্দুর রশীদ জানান, ছোটবেলা থেকেই তার ছেলে আশরাফুল ও জরেজের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। আগে তারা একসঙ্গে ব্যবসা করলেও জরেজ মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর পর আশরাফুল একাই ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তিনি বলেন, “জরেজ আমাকে বলেছে যে জাপান যাওয়ার জন্য অনেক টাকা লাগবে এ জন্য আশরাফুল আমাকে টাকা দিতে চেয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে আমি হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা করে আমার ছেলে বলে বাবা ঢাকায় যাচ্ছি। এ সময় রাতে যেতে নিষেধ করলে আশরাফুল বলেন সমস্যা নেই। আমার জন্য দোয়া করেন। পরে তার বন্ধু জরেজসহ ঢাকায় যান।”
ঢাকায় যাওয়ার পর বুধবার সন্ধ্যা থেকে আশরাফুলের মোবাইলে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাননি তার স্ত্রী। প্রতিবারই ফোন বেজে কেটে গেলেও কেউ ধরছিল না।
প্রতিবেশী এনামুল হক বলেন, “ফোন রিসিভ না করায় বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য জরেজের বাড়িতে যান আশরাফুল হকের স্ত্রী লাকি বেগম। এ সময় লাকী বেগমকে জরেজের স্ত্রী বলেন, টেনশন করিও না তারা দুইজন তো একসঙ্গে আছে।” পরে লাকি বেগম আবারও স্বামীর নম্বরে কল করলে জরেজ ফোন রিসিভ করে বলেন, “ফোন আমার কাছে রেখে আশরাফুল বাইরে গেছে। কিন্তু সে কোথায় আমি জানি না।”
এর কয়েক ঘণ্টা পরই জাতীয় ঈদগাহের সামনে ড্রামের ভেতর থেকে খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে ছবি দেখে এবং অন্যান্য তথ্য মিলিয়ে মরদেহটি আশরাফুলের বলে শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা।
গ্রামের বাড়িতে এখন শোকের মাতম। আশরাফুলের মৃত্যুতে তার বাড়ি ও আশপাশের এলাকায় নেমে এসেছে নীরবতা, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার জরেজের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম আতিকুর রহমান বলেন, “নিহত আশরাফুল হকের পরিবারের সদস্যদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য রমনা জোনের ডিসি ও শাহবাগ থানার ওসিকে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, নিহত আশরাফুলের একজন বড় বোন ঢাকায় থাকেন। বাড়ি থেকে তার স্ত্রীর ভাইও ঢাকায় যাচ্ছেন। “দুজনের মধ্যে যে কেউ মামলা করতে পারেন।”