কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়োগ-পদোন্নতিতে স্থবিরতা, গভর্নরের সিদ্ধান্তে কর্মকর্তাদের ক্ষোভ
- ফরিদ শ্রাবণ
- প্রকাশঃ ০৩:৫৪ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ ও পদোন্নতির স্থবিরতা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাম্প্রতিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, আচরণ এবং কর্মপরিবেশকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি গভর্নরের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের পাঠানো একটি চিঠিতে এসব অভিযোগ ও অসন্তোষের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐতিহ্য ছিল গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত ও স্বচ্ছ যোগাযোগ রক্ষা। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্তে সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, যা কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্বস্তি ও হতাশা তৈরি করেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ভবনের ৪র্থ তলায় অবস্থিত এক্সিকিউটিভ ফ্লোরের সব প্রবেশদ্বার হঠাৎ করে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এখন শুধু লিফট ব্যবহার করে ওই ফ্লোরে যেতে হচ্ছে। এই ঘটনা নজিরবিহীন এবং কর্মকর্তাদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে। এক সূত্র অনুযায়ী, গভর্নরের ফ্লোরে প্রবেশ সীমিত করে দরজায় তালা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এটি অত্যন্ত অপমানজনক ও দৃষ্টিকটু একটি সিদ্ধান্ত, যা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অনেকের ধারণা, কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রাখার উদ্দেশে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা এ সিদ্ধান্তকে প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরির ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, বিরূপ পদোন্নতি নীতিমালা কিংবা কর্মকর্তাদের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ করতে গভর্নর ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছেন।
এ বিষয়ে নারীকর্মীরাও নিরাপত্তাহীনতা ও অস্বস্তির অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, বিকল্প পথ ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়ায় এটি কর্মপরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশাসনের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত দূরত্ব তৈরির মাধ্যমে গভর্নর পদোন্নতি ও নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে কর্মকর্তাদের স্বার্থবিরোধী নীতিমালা গৃহীত হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারাও অংশগ্রহণমূলক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু কাউন্সিলের দাবি, ১৯ মার্চ গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের কাছে সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা দেওয়ার পরও আট মাসে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
কাউন্সিল জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের জন্য গত ১৯ মার্চ গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের কাছে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর বলেছিলেন, কাউন্সিলকে সংস্কার কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু আট মাস পার হলেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকে পদশূন্যতার সংখ্যা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে। চলতি বছরের ৩০ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, ৬ হাজার ২৬০ জন প্রথম শ্রেণির পদের মধ্যে ১ হাজার ৯৩৬টি এখনো শূন্য। অন্যদিকে, অতিরিক্ত সূত্রে জানা গেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত রয়েছে। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নতুন নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া বন্ধ। প্রতিবছরের আগস্ট মাসে নতুন প্যানেল অনুমোদনের নিয়ম থাকলেও এবার তা কার্যকর করা হয়নি। প্রথম শ্রেণির ৬ হাজারেরও বেশি পদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার পদ এখনো খালি, এবং চারটি নির্বাহী পরিচালক (ইডি) পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। গত ১৯ মে অতিরিক্ত পরিচালক (এডি) পদে সর্বশেষ পদোন্নতি দেওয়ার পর থেকে আর কোনো পদোন্নতি হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসে পদোন্নতির কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে যোগ্য কর্মকর্তারা তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নির্বাহী পরিচালকের চারটি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ৩১ আগস্টভিত্তিক নতুন প্যানেল এখনো অনুমোদিত না হওয়ায় যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। কাউন্সিলের অভিযোগ, পদোন্নতি ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা ঢাকা ওয়াচকে বলেন, ‘সচিবালয়ের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকেও কেডার বৈষম্য বিদ্যমান। এখানে সব সাইডকে নিয়ন্ত্রণ করে জেনারেল সাইড। প্রশাসনিক ক্যাডারের মতো জেনারেল সাইড বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ ও অফিসার্স কাউন্সিল উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কাজেই জেনারেল সাইডের নির্লিপ্ততার কারণে পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা ওয়াচকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন হয়। কিছু প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বিলম্ব হচ্ছে, তবে শীঘ্রই তা সম্পন্ন হবে। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের ক্ষোভের কিছু নেই।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দুদকের অনুরোধে ব্যাংকের পরিদর্শকরা নিয়মিত কাজ করলেও সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে তাদের বিরুদ্ধেই অনিয়মের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সরকারি ব্যাংকের ঋণ বরাদ্দে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকলেও দুদকের প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম জড়ানো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গভর্নরকে একাধিকবার অবহিত করা হলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।
এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় দুদকের অনুরোধে প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথি সরবরাহ করে আসছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ৪৪ ধারার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেন, যা মূলত নমুনাভিত্তিক। সব ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম পরিদর্শনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। কিন্তু দুদকের সাম্প্রতিক এক পত্রে প্রায় সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ তোলা হয়েছে, যা বাস্তবতা বিবর্জিত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে পরিদর্শন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা অযথা হয়রানি ও মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হচ্ছেন।
কাউন্সিল জানিয়েছে, অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৫ম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তারা গাড়ি সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এখনো তা থেকে বঞ্চিত। ব্যক্তিগত লকার হঠাৎ স্থগিত হওয়ায় কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসুবিধার মুখে পড়েছেন।
এছাড়া, সিনিয়র কর্মকর্তা জুনিয়রদের চেয়ে কম বেতন পাওয়ার অসামঞ্জস্য দূর করতে কোনো উদ্যোগ না নেওয়া, প্রশিক্ষণ ভাতা ও মেয়াদ কমানোসহ সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে। তাদের মতে, এসব সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করে দিচ্ছে।
কাউন্সিল আরও অভিযোগ করেছে, গভর্নর অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে উচ্চ পারিশ্রমিকভুক্ত উপদেষ্টা ও কনসালটেন্টদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, যাদের অনেকেই দেশের ব্যাংকিং বাস্তবতা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত ধারণা রাখেন। ফলে তাদের পরামর্শ বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কাউন্সিল জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাক্ষাতের অনুরোধ জানালেও গভর্নর ছয় মাসে একবার বৈঠকের প্রস্তাব দেন। অথচ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে।
ট্রেনিং অ্যাকাডেমির প্রেষণ ভাতা বাতিল, প্রশিক্ষণের মেয়াদ ও ভাতা কমানোসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। কর্মকর্তারা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করতেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাউন্সিল এসব বিষয়ে অনেকবার গভর্নরকে অবহিত করলেও তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে অতীতে স্বচ্ছ পদোন্নতি নীতিমালার কারণে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বলা হচ্ছে, কর্মকর্তারা নাকি ‘অদক্ষ’, তাই নীতিমালা পরিবর্তন করা হবে।
কর্মকর্তাদের মতে, দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ না নিয়েই নীতিমালা পরিবর্তন করলে এতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুইটি দাবি উত্থাপন করেছেন: অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর গভর্নরের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যবস্থা করা। তাদের বক্তব্য, “আমরা সবসময় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব, তবে এজন্য উন্মুক্ত যোগাযোগ ও আস্থার পরিবেশ প্রয়োজন।”
কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, দ্রুত সমাধান না এলে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসনিক অচলাবস্থায় পড়তে পারে। তাই গভর্নরের কাছে এখনই অংশগ্রহণমূলক ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।