বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন ভাবে কমছে প্রজনন হার: জাতিসংঘ
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১০:৫৮ পিএম, ১১ জুন ২০২৫
পাঁচ বছর আগে প্রথম সন্তানের জন্মের পর দ্বিতীয় সন্তানের কথা ভাবেননি এমন নন মুম্বাইয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কর্মী নম্রতা নাঙ্গিয়া এবং তার স্বামী। কিন্তু চিন্তার জায়গাটা ছিল স্পষ্ট—“আরেকটা বাচ্চার খরচ চালাতে পারব তো?”
স্বামী টায়ার কোম্পানিতে চাকরি করেন, কিন্তু এক শিশুর পিছনে খরচই এত বেশি—স্কুল ফি, বাস ভাড়া, সাঁতার শেখা, এমনকি ডাক্তারের কাছে যাওয়াটাও মহার্ঘ।
“আমাদের সময় তো এসব ছিল না,” বললেন নম্রতা। “শুধু স্কুলেই যেতাম, কোনো এক্সট্রা অ্যাক্টিভিটি ছিল না। এখন তো সাঁতার শেখাতেই হয়, আঁকা শেখাতেই হয়, সব কিছুতেই বাচ্চাকে দক্ষ করতে হয়।”
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নম্রতার অভিজ্ঞতা এখন বৈশ্বিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক নিয়ে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
ইউএনএফপিএ ১৪টি দেশে ১৪ হাজার মানুষের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়ে বলেছে, প্রতি পাঁচজনে একজন মনে করেন,তারা অতীতে বা ভবিষ্যতে তাদের কাঙ্খিতসংখ্যক সন্তান নিতে পারেননি বা পারবেন না।
কারণ হিসেবে উঠে এসেছে—অর্থনৈতিক চাপ, সময়ের অভাব, অথবা উপযুক্ত সঙ্গীর অভাব।
জরিপে অংশ নেওয়া দেশগুলো হল—দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইতালি, হাঙ্গেরি, জার্মানি, সুইডেন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়া।
এই দেশগুলো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মধ্যে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ আয়ের দেশ রয়েছে। জরিপ চালানো হয়েছে তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রজননের সময় পেরিয়ে গেছে এমন মানুষের ওপর।
ইউএনএফপিএ প্রধান ড. নাতালিয়া কানেম বলেন, “বিশ্বজুড়ে প্রজনন হার নজিরবিহীনভাবে কমে গেছে। জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ মানুষ দুটি বা তার বেশি সন্তান চান। কিন্তু বাস্তবে তারা কাঙ্খিত পরিবার গড়তে পারছেন না। এটাই এখন প্রকৃত সংকট।”
জরিপ চালানো সব দেশ মিলিয়ে এতে অংশ মানুষদের ৩৯ শতাংশই বলেছেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সন্তান নিতে পারেননি। এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ কোরিয়ায় (৫৮ শতাংশ) এবং সবচেয়ে কম সুইডেনে (১৯ শতাংশ)।
এছাড়াও কাঙ্ক্ষিতসংখ্যক সন্তান না নিতে পারার জন্য জন্মদানে অক্ষমতাকে দায়ী করেছেন ১২ শতাংশ মানুষ।
এই হার কয়েকটি দেশে বেশি- যেমন: থাইল্যান্ড (১৯ শতাংশ), যুক্তরাষ্ট্রে (১৬ শতাংশ) দক্ষিণ আফ্রিকা (১৫ শতাংশ), নাইজেরিয়া (১৪ শতাংশ) এবং ভারত (১৩ শতাংশ)।
ইউএনএফপিএ দেখতে পেয়েছে যে, কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় সন্তান নিতে না পারার পেছনে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার চেয়েও বড় বাধা হিসেবে এসেছে সময় না থাকার বিষয়টি।
মুম্বাইয়ের নম্রতা সেটিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে তার। বাড়ি ফিরে মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে চান, কিন্তু তখন শরীরটা ক্লান্ত।
“দিন শেষে সেই মায়ের অপরাধবোধটা আসে—বাচ্চার সঙ্গে ঠিক মতো সময় কাটাতে পারছি না। তাই আমরা ঠিক করেছি, একটাই যথেষ্ট,” বলেন তিনি।
ইউএনএফপিএ’র জরিপে দেখা গেছে, ৫০ বছর বয়স পেরিয়েছেন এমন অংশগ্রহণকারীদের ৩১ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা চেয়েছিলেন আরও সন্তান, কিন্তু পারেননি।
এই প্রবণতা ইউরোপে দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেলেও এবার তা বৈশ্বিক স্তরে উঠে এসেছে, বলছেন ফিনল্যান্ড সরকারের জনসংখ্যা উপদেষ্টা আন্না রটকির্চ।
ইউএনএফপিএ প্রধান ড. নাতালিয়া কানেম বলেন, ৪০ বছর আগেও চীন, কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ছিল জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। এখন এসব দেশই সন্তান সংখ্যা বাড়াতে চায়।
‘হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-এর জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক স্টুয়ার্ট গিয়েটেল-বাস্টেন বলেন, “এই প্রথম জাতিসংঘ প্রজনন হারের দিকটিতে এত গুরুত্ব দিয়ে কথা বলল।”
কিছুদিন আগেও তারা এমন নারীদের গুরুত্ব দিত যাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সন্তান ছিল এবং যাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল। তারপরও এখন তারা কম প্রজনন হারের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছে।