৭ অক্টোবর স্মরণ ইসরায়েলিদের, মিশরে দুই পক্ষের শান্তি আলোচনা


৭ অক্টোবর স্মরণ ইসরায়েলিদের, মিশরে দুই পক্ষের শান্তি আলোচনা

দুই বছর আগে ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় যে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল, সেটিই আজকের দীর্ঘস্থায়ী গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত। সেই দিনটি স্মরণে দেশজুড়ে শোক ও শ্রদ্ধা পালন করেছে ইসরায়েলিরা। অন্যদিকে, যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মিশরের রিসোর্ট শহর শার্ম আল শেখে দ্বিতীয় দিনের মতো পরোক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধি দল।

২০২৩ সালের ওই ৭ অক্টোবরের হামলায় ১,২০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয় গাজায়। এটি ছিল হলোকাস্ট-পরবর্তী সময়ে ইহুদিদের ওপর এক দিনে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এই পরিসংখ্যানকে বিশ্বাসযোগ্য বলে উল্লেখ করেছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, “অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ইসরায়েলিদের। রক্তপিপাসু শত্রুরা আমাদের ওপর কঠিন আঘাত হেনেছে, কিন্তু তারা আমাদের ভাঙতে পারেনি।”

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও ওই হামলার কথা স্মরণ করে বলেন, “সেই অন্ধকার ও বিভীষিকা আমাদের সবার স্মৃতিতে চিরকাল দগ্ধ হয়ে থাকবে।” তিনি আরও আহ্বান জানান, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত গাজা শান্তি পরিকল্পনায় রাজি হওয়ার, যা তার মতে “রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানের ঐতিহাসিক সুযোগ।”

৭ অক্টোবর স্মরণে ইসরায়েল সরকার আনুষ্ঠানিক আয়োজন ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত রাখলেও মঙ্গলবার সারা দেশজুড়ে নানা স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। তেল আবিবে নিহতদের পরিবারগুলোর আয়োজনে একটি বড় অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠান শুরুর আগে সারা দেশে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এদিকে, মিশরের শার্ম আল শেখে দ্বিতীয় দিনের মতো যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে। এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, “সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফা আলোচনায় বসা হয়, তবে সকালে হওয়া বৈঠকে কোনো অগ্রগতি হয়নি।” হামাস দাবি করছে, গাজা থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহারে নিশ্চয়তা না পাওয়ায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “আলোচনাগুলো খুবই কঠিন, এখনো কোনো বাস্তব অগ্রগতি হয়নি, তবে মধ্যস্থতাকারীরা আপসের পথ খুঁজতে কঠোর পরিশ্রম করছেন।”

আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মোট পাঁচটি ইস্যু নিয়ে আলোচনা চলছে—স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থা।

বিবিসির আরেক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ স্টিভ উইটকফ ও জ্যারেড কুশনার বুধবার মিশরে পৌঁছাবেন। ট্রাম্প আগের দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের একটি বাস্তব চুক্তি করার ভালো সুযোগ আছে, যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।”

জেরুজালেমে নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে জিম্মিদের পরিবারের প্রতি সংহতি জানাতে শতাধিক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বর্তমানে গাজায় ৪৮ জন ইসরায়েলি বন্দি আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত।

বন্দিদের এক স্বজন আতালিয়া রেগেভ বিবিসিকে বলেন, “জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন হলে সব ধরনের সমঝোতা করতে হবে, তবে আমাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।”

জনমত জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৭০ শতাংশ ইসরায়েলি নাগরিক যুদ্ধের অবসান ও জিম্মিদের মুক্তি চান।

তেল আবিবের নোভা সঙ্গীত উৎসবে নিহতদের স্মরণেও আয়োজন হয় শ্রদ্ধা নিবেদনের। এর কাছাকাছিই গাজায় তীব্র বোমাবর্ষণ চলছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষায়, “রাতভর বিমান হামলার শব্দে আকাশ কেঁপে উঠছিল।”

মঙ্গলবার ভোরে গাজার তাল আল-হাওয়া, রিমাল, নাসর, শেখ রাদওয়ান এবং শাতি শরণার্থী শিবিরে বোমাবর্ষণের খবর পাওয়া যায়।

বাস্তুচ্যুত ইমান আল-ওয়াহিদি জানান, “প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই ভয়ে থাকি। আমি আর আমার তিন সন্তান সারারাত একসঙ্গে ঘুমাই, একে অপরকে জড়িয়ে থাকি, বিশেষ করে ছোট ছেলেটি আমার গায়ে মাথা রেখে ঘুমায়।”

আল-শিফা হাসপাতাল জানিয়েছে, মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ছয়জনের মরদেহ সেখানে আনা হয়, যার মধ্যে তিনজন আল-সাবরা এলাকায় নিহত হন। খান ইউনুসের নাসের হাসপাতাল জানিয়েছে, আরও দুইজন নিহত হয়েছেন, তাদের একজন ত্রাণ সংগ্রহের সময় গুলিতে প্রাণ হারান।

ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার নাসের হাসপাতালের ভয়াবহ পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, “আহত শিশু ও মায়েরা করিডোরের মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনটি শিশু ও তিনজন মা এক বিছানায় শুয়ে আছেন—একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে পালাক্রমে শ্বাস নিচ্ছেন।”

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে ২৫টি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে, বাকি ১৩টি আংশিকভাবে চলছে।

এদিকে ইসরায়েলি সেনারা জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকালে উত্তর গাজা থেকে ছোড়া একটি রকেট নেতিভ হাআসারা এলাকায় পড়ে। কোনো হতাহতের খবর মেলেনি।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, ফলে দুই পক্ষের দাবি-প্রত্যাখ্যান যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন dhakawatch24@gmail.com ঠিকানায়।
×