শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র
চোখের সামনে থেকেই শত শত কোটি ডলার চুরি
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১০:৫৬ এম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস সম্প্রতি একটি তদন্তমূলক তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। ‘বাংলাদেশের হারানো বিলিয়ন: চোখের সামনেই চুরি’ শিরোনামের তথ্যচিত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থ কীভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে এবং সেই অর্থ ফেরত আনার কতটা চ্যালেঞ্জপূর্ণ তা তুলে ধরা হয়েছে।
তথ্যচিত্রের শুরুতেই শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পটভূমি তুলে ধরা হয়। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যা দীর্ঘদিন জমে থাকা জনঅসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ছিল। এ সময় হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আরও প্রকট হয়, বিরোধীদের নির্বিচারে গ্রেফতার, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির খবর ফাঁস হওয়ায় জনমনে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, এই পাচার হওয়া অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গিয়েছে যুক্তরাজ্যে।
তথ্যচিত্রে শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার পরিবারের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককেও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে টিউলিপ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানানো হয়।
চলতি বছরের শুরুতে টিউলিপ সিদ্দিক একটি ফ্ল্যাট দুর্নীতির ঘটনায় নিজের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এফটির অনুসন্ধানী টিমের খোঁজে জানা গেছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তির মালিক।
ব্রিটিশ দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন স্পটলাইট অন করাপশন-এর উপপরিচালক হেলেন টেলর বলেন, "পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশের একজন মন্ত্রীর পক্ষে যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তি কেনা বিস্ময়কর। যেখানে এক ব্যক্তি বছরে দেশের বাইরে ১২ হাজার ডলারের বেশি নিতে পারেন না।"
তথ্যচিত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA) ইতোমধ্যে ৩৫০টি সম্পত্তি জব্দ করেছে, যেগুলোর মধ্যে এফটির অনুসন্ধানে পাওয়া ৩০০টির সঙ্গে মিল রয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাক্কলন তুলে ধরা হয়েছে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোশতাক খান বলেন, "উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির সাধারণ ধারা হলো, শাসক দলকে তার সমর্থকদের মধ্যে টাকা বিলাতে হয়। তা না হলে ক্ষমতায় টিকতে পারে না। আমার মনে হয়, শাসনামলের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ অর্থনীতি ও নিজেদের দল– দুয়েরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল।"
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, দুর্নীতির মাধ্যমে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সহায়তায় একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছেন শাসনঘনিষ্ঠরা। অভিযোগ রয়েছে, অস্ত্রের মুখে ব্যাংক পরিচালকদের দিয়ে জোরপূর্বক শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করানো হয়েছে। এসব শেয়ার পরে চলে গেছে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠজনদের হাতে।
অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে, এস আলম গ্রুপ একাই বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক বিলিয়ন ডলার, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিয়েছে।
দুর্নীতির খবর সবার জানা ছিল, কিন্তু মুখ খুলতে সাহস করেনি কেউ
প্রধান অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মধ্যে ‘পদ্মা সেতু’ এবং দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকেও দুর্নীতির আওতায় আনা হয়েছে বলে জানানো হয়। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল।
অধ্যাপক মোশতাক খান আরও বলেন, "এগুলোর কিছুই গোপন ছিল না। পত্রপত্রিকায় ছিল, মিডিয়ায় আলোচনা হতো, দুর্নীতি ছিল প্রকাশ্য, চোখের সামনে; কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অধিকাংশ মানুষ ছিল আতঙ্কে। তারা জানত, কথা বললে গায়েব হয়ে যেতে পারে। দুর্নীতির কথা সবাই জানত, তবু চুপ করে থাকত।"
সম্পদ উদ্ধার অভিযানে জটিলতা
সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়াকে এক জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি লড়াই হিসেবে বর্ণনা করেছেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ইফতি ইসলাম। তিনি বলেন, "আপনি যখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার চুরি করেন, তখন আপনি বিশ্বের সেরা আর্থিক কাঠামোবিদ, পরামর্শক ও আইনজীবীদের ভাড়া করতে পারেন, যারা আপনার টাকা সরানো ও লুকাতে সাহায্য করেন। এটা সম্পদ উদ্ধারে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। আপনি টাকার হদিস না পেলে তা ফেরত আনতে পারবেন না।"
একই সঙ্গে তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে অনেক সময় চুক্তির মাধ্যমে আপস করতে হয়, যা জনমানসে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মন্তব্য করেন, "মানুষ বলে, সব টাকা আদায় সম্ভব নয়। আমরা যেটুকু পারি, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু তার জন্য কঠিন প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে, পথ অনুসরণ করতে হবে; সংশ্লিষ্ট বিদেশি সরকারের সহযোগিতা পেতে হবে।"
এফটির কৃষি ও কমোডিটি বিষয়ক প্রতিবেদক সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, "যদি ইউনূস প্রশাসন অন্য দেশের সরকারগুলোকে যেমন যুক্তরাজ্যে এনসিএ যা করেছে, তেমন পদক্ষেপে রাজি করাতে পারে, তাহলে চাকা ঘুরতে শুরু করবে এবং থামানো কঠিন হবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। যারা শেখ হাসিনার আমলে অর্থ পাচার করেছে, তারা ভবিষ্যতের সরকারের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করবে, তার ওপরেই নির্ভর করবে দেশে দুর্নীতি কতটা ব্যাপক থাকবে।"
রাজনৈতিক পরিবর্তন, না পুনরাবৃত্তি?
এফটির দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড এই রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাব্য মোড়বদল হিসেবে দেখছেন। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, নতুন সরকারও হয়তো পুরনো রাজনৈতিক প্যাটার্ন অনুসরণ করে, যেখানে ক্ষমতা এক দলের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এই দলে হয়তো এবার বিএনপির নাম আসবে।
ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি বলেন, "আমাদের ভয়, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারব না। এটাই এখন সবচেয়ে বড় আশঙ্কা।"