বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কেন সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে ভারত?


বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কেন সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে ভারত?

বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে কাছে অবস্থানকারী শিলিগুড়ি করিডোর যা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত ঘিরে ভারতের সাম্প্রতিক সামরিক নড়াচড়া নিয়ে দুই দেশের অভ্যন্তরে আলোচনা তীব্র হচ্ছে। আসাম ও উত্তর দিনাজপুরে দুটি নতুন সেনা ঘাঁটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর বিষয়টি আরো গুরুত্ব পেয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই পদক্ষেপ মূলত শিলিগুড়ি করিডোরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সামরিক সক্ষমতা জোরদারের অংশ। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর উদ্ভূত নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও এই সামরিক তৎপরতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যকে সংযুক্ত রাখা এই করিডোরটিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর মনে করে দিল্লি। এর চারপাশে চীনসহ একাধিক দেশের সীমান্ত থাকায় অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই কৌশলগতভাবে ভারতের কাছে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সীমান্তসন্নিহিত এলাকায় ভারতের সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন লালমনিরহাটে সীমান্তের ৬২ কিলোমিটার ‘ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে’—এমন একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

লালমনিরহাটে কী ঘটছে?

লালমনিরহাটের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত দীর্ঘ ৩৪৫ কিলোমিটার। ছড়িয়ে পড়া গুজব যাচাই করতে বিজিবি সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে।

লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের প্রায় দেড়শ কিলোমিটার সীমান্তের দায়িত্বে থাকা ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম বিবিসি বাংলাকে জানান, প্রকাশিত তথ্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

তিনি বলেন, "এটা আমার নজরে পড়েছে যে লালমনিরহাটেরে প্রায় ৬২ কিলোমিটার এলাকা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক দখল হয়ে আছে। এরকম একটি ফেব্রিকেটেড নিউজ আমাদের কাছে এসেছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই এটা সম্পূর্ণ একটা গুজব।"

তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক, নিয়মিত টহল অব্যাহত আছে এবং বিএসএফের সঙ্গে যৌথ টহলও চলছে।

ধরলা নদীর তীরে মোগলহাট এলাকায় দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দারা স্বাভাবিকভাবে মাঠে কাজ ও নৌকায় চলাচল করছেন, আর বিজিবি সদস্যরা নিয়মিত পাহারায় আছেন। স্থানীয়রা স্পষ্টভাবে বলছেন—সীমান্ত দখল বা অনুপ্রবেশের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তবে তারা মনে করেন, গত ৫ আগস্টের পর বিএসএফ টহল ও নজরদারি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। স্থানীয় শিল্পী বেগম জানান, “আগে ৫/৬ জন টহল দিত, এখন ১৫/১৬ জন দেয়। এখন ঝুপড়িও বাড়াইছে।”

এর পাশাপাশি বিএসএফের গুলির ঘটনাও অব্যাহত রয়েছে। ১১ নভেম্বর অনুপ্রবেশের পর গুলি চালনায় তিন বাংলাদেশি আহত হন।

ভারত কী করছে সীমান্তের কাছে?

শিলিগুড়ি করিডোর এলাকায় চলতি বছরের শুরুতে ভারতের তিন বাহিনীর বড় আকারের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে আসামের ধুবরি ও উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় দুটি নতুন সেনা ঘাঁটি নির্মাণের কাজ চলছে—যেগুলো বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে অতি নিকটে।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জী বলেন, এই পদক্ষেপ ভারতের সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ, যা চীনের তৎপরতা ও শিলিগুড়ি করিডোরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “ওখানটায় একটা সেনসিটিভ সিচ্যুয়েশন আছে… আমাদের যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রস্তুত থাকতে হবে।”

তার মতে, এই উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলাদেশে মূল্যায়ন

বিজিবির লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম মনে করেন, ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন অনুযায়ী ঘাঁটি নির্মাণ করতে পারে, এবং এখন পর্যন্ত এমন কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য সীমান্তে দেখা যায়নি যা উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

সাবেক মেজর জেনারেল মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, ভারতের সিদ্ধান্তের পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করছে—শিলিগুড়ি করিডোর সুরক্ষা, চীনের প্রভাব মোকাবিলা এবং বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা।

তিনি উল্লেখ করেন, লালমনিরহাট বিমানবন্দর ও তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

তার মতে, ভারতের এই উপস্থিতিকে সামরিক পরিভাষায় ‘গ্রে জোন ব্যাটল’ বলা যায়—যেখানে যুদ্ধ ছাড়াই প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে চাপে রাখা হয়।

তিনি মন্তব্য করেন, “এটাকে মনে হচ্ছে গ্রে জোন ব্যাটল ফর বাংলাদেশ… বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলা।”

বিশ্লেষকদের মতে, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন রয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক হুমকি নয়, তবে সীমান্তের ভূপ্রকৃতি ও জিও-স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে অন্য শক্তি যদি এখানে প্রভাব বিস্তার করে তাই দিল্লির দুশ্চিন্তার কারণ।

সূত্রঃ বিবিসি 

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন dhakawatch24@gmail.com ঠিকানায়।
×