ভারতের গার্মেন্টস খাত থেকে বিদেশি অর্ডার চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৮:১৮ পিএম, ১০ আগস্ট ২০২৫
ভারতের পোশাক শিল্প বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে দেশটির গার্মেন্টস রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে ভারত থেকে অর্ডার স্থগিত করে তা সরিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে, যাদের ওপর মার্কিন শুল্ক অপেক্ষাকৃত কম।
রবিবার দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রকাশিত এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর — যেটিকে ভারতের ‘নিটওয়্যার রাজধানী’ বলা হয় — সেই অঞ্চলের রপ্তানিকারকরা শুল্কের চাপ সরাসরি অনুভব করতে শুরু করেছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক পুরনো ক্রেতা নতুন অর্ডার দিচ্ছেন না; বরং অর্ডার বাতিল করছেন কিংবা স্থানান্তর করছেন। এদের বেশিরভাগই পণ্য সরিয়ে নিচ্ছেন এমন দেশগুলোতে, যেগুলোর মার্কিন বাজারে প্রবেশে তুলনামূলক কম শুল্ক প্রযোজ্য — ১৯ থেকে ৩৬ শতাংশের মধ্যে।
তিরুপ্পুরের এক রপ্তানিকারক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, তার মার্কিন ক্রেতারা বর্তমানে অর্ডার পাকিস্তানে স্থানান্তর করেছে। আরেকজন জানান, একজন আমেরিকান ক্রেতা তাকে গ্রীষ্মকালীন অর্ডার চূড়ান্ত করার আগে “অপেক্ষা করতে” বলেছেন। অন্য একজন জানান, “ক্রেতারা আগে ২৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির বোঝা আমাদের বহন করতে বলছিলেন, আর এখন সেটা এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।”
বর্তমানে কিছু নির্দিষ্ট ভারতীয় নিটওয়্যার পণ্যের ওপর কার্যকর মার্কিন শুল্ক ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এতে করে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের দাম ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হয়ে পড়ছে। রপ্তানিকারকদের অনেকে এখন এই শুল্ককে ‘এক ধরনের বাণিজ্যিক অবরোধ’ হিসেবে দেখছেন।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, তামিলনাড়ুর টেক্সটাইল শিল্প যখন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে। তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও কারুর— এই তিন অঞ্চলের কারখানায় প্রায় ১২.৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যারা বছরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করে থাকেন।
কিছুদিন আগেও ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) এবং চীন ও মিয়ানমারের ওপর উচ্চ শুল্কের কারণে ভারতের প্রতি মার্কিন আগ্রহ বাড়বে বলে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। সেই আশায় অনেক রপ্তানিকারক নতুন যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগও করেছিলেন। তবে অতিরিক্ত শুল্ক সেই আশাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (TEA) সভাপতি কে এম সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, “এটি বড় ধাক্কা। প্রথমে স্বতন্ত্র রপ্তানিকারক বিভিন্ন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্রেতারা ইতোমধ্যে আমাদের শুল্কের অংশ ভাগাভাগি করে নিতে বলছে। আমাদের মুনাফা মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ; আমরা কীভাবে এই ব্যয় ভাগাভাগি করব।”
তার মতে, তিরুপ্পুর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু বাজার থেকে কিছুটা সুরক্ষা মিলতে পারে, তবে সেটিও সম্পূর্ণ ক্ষতি ঠেকাতে পারবে না। “ব্র্যান্ডের বাইরে ক্রেতারা শিগগিরই সরে যাবে। আমাদের সামাজিক মানদণ্ড ও কার্যপ্রণালী মেনে চলার কারণে ব্র্যান্ডগুলো থাকতে পারে। কিন্তু তাতেও আমাদের কিছুদিন রক্তক্ষরণ হবে।”
শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, রপ্তানি ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমে গেলে তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর এবং কারু অঞ্চলে এক থেকে দুই লাখ শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়বে।
তিরুপ্পুর থেকেই প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি রুপির নিটওয়্যার রপ্তানি করা হয়। এই অঞ্চলের কারখানাগুলো ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, কস্টকোর মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের সরবরাহকারী। এখানে তৈরি হয় ভারতের নিটওয়্যার রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ। এখানকার অনেক রপ্তানিকারক ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১০-১৫ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধির আশা করেছিলেন। কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুলা ও নিটওয়্যার পোশাক খাতে মার্কিন অর্ডার ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব শুধু পোশাকেই নয়, বরং হোম টেক্সটাইল পণ্যে ব্যবহৃত পণ্যেও পড়তে শুরু করেছে। কোয়েম্বাটুর ও কারু—যেখানে প্রচুর হোম টেক্সটাইল পণ্য তৈরি হয়—সেখানকার রপ্তানিকারকরা জানাচ্ছেন, বিছানার চাদর ও তোয়ালের মতো পণ্যের অর্ডার বাতিল বা বিলম্বিত হচ্ছে।
সাউদার্ন ইন্ডিয়া মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কে সেলভারাজু বলেন, “যারা পোশাকের অর্ডারের বিষয়ে অগ্রিম খোঁজ-খবর নিয়েছিল, তারা এখন অপেক্ষা করতে বলছে। এই মৌসুম মিস হয়ে গেলে আর সুযোগ পাওয়া যাবে না।”
কারু অঞ্চল থেকে প্রতিবছর প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপির হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়, যার মধ্যে ৬ হাজার ৯০০ কোটির পণ্য সরাসরি বিদেশে পাঠানো হয়। কোয়েম্বাটুর থেকে বিপুল পরিমাণ তুলার তোয়ালে ও কিচেন লিনেন রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যা এখন উচ্চ শুল্কের ফাঁদে পড়েছে।
সেলভারাজু বলেন, “এটি কেবল শুল্ক বৃদ্ধি নয়, বরং ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।” তিনি ভারতের তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং জিএসটি-সংক্রান্ত বৈষম্যের কথাও তুলে ধরেন। তার মতে, এসব কারণে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববাজারে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে কৃত্রিম তন্তুর ওপর ১৮ শতাংশ, সুতায় ১২ শতাংশ এবং তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ জিএসটি প্রযোজ্য, যা রপ্তানি খরচে অতিরিক্ত ৬-৭ শতাংশ যোগ করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে এ ধরনের বোঝা নেই।
আরও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে, ভারতের বাজারে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তুলার গুণগত মান নিয়ে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ব্রাজিলের তুলা মার্কিন মানদণ্ডে সবসময় উত্তীর্ণ হয় না। এই পরিস্থিতিতে, ব্রাজিলীয় তুলা আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি শুল্কমুক্ত রপ্তানি চুক্তি করার আহ্বান জানিয়েছেন সেলভারাজু।
তার মতে, ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কঠোর শুল্কের মুখে পড়েনি। বাংলাদেশ এখনও ৩৫–৩৬ শতাংশ শুল্কে রপ্তানি করছে, পাকিস্তান ১৯ শতাংশ, ভিয়েতনাম ২০–২১ শতাংশ, আর কম্বোডিয়ার শুল্ক ৪৯ থেকে কমে ১৯ শতাংশে নেমেছে। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ শুল্ক এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় — বরং নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক তৈরি পোশাক কারখানার মালিক বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে আসা অর্ডার সরাসরি পাকিস্তানে চলে গেছে। “সম্ভবত তারা ভালো দাম দিয়েছে। অর্ডার হাতছাড়া হয়ে গেছে।” বলেন তিনি।
সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, “মার্কিন বাজারে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। তাদের ২০ শতাংশ শুল্ক মানে পোশাক অনেক সস্তা। আপনার মুনাফা যখন মাত্র ৫ শতাংশ, তখন এই শুল্ক অনেক বড় বিষয়। ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমানে এই মুনাফা কার্যত উধাও হয়ে গেছে।”
তার দাবি, তুলা আমদানির ওপর ১১ শতাংশ শুল্ক ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর জিএসটি পর্যালোচনা জরুরি। “আমাদের রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে হলে সব কাঁচামালের ওপর শুল্ক ৫ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ভারত স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের কাছে মার্কিন বাজার হারাতে পারে,” বলেন তিনি।
তার মতে, এই দেশগুলোর মার্কিন বাজারে ‘ল্যান্ডেড প্রাইস’ ভারতের চেয়ে অনেক কম, যা ভারতীয় রপ্তানিকারকদের চাপে ফেলেছে।
সেলভারাজু বলেন, “মার্কিন বাজার এখনও আমাদের কাছ থেকে কিনতে চায়। তারা ভারতীয় তুলা ও মান পছন্দ করে। কিন্তু রাজনৈতিক ও নীতি-সংক্রান্ত বাধা তাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।”
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস